শ্রেণিকক্ষে শিক্ষককে বাতাস করা - এত সমালোচনা কেন ?
লেখার শুরুতেই একটি কবিতার কথা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। কবিতাটির নাম শিক্ষাগুরুর মর্যাদা । এর এটি লিখেছেন কাজী কাদের নেওয়াজ। পাঠকদের সামনে পুরো কবিতাটি তুলে ধরা হলো--। পরে আমার কথা বলছি।
বাদশাহ আলমগীর-
কুমারে তাঁহার পড়াইত এক মৌলভী দিল্লীর।
একদা প্রভাতে গিয়া
দেখেন বাদশাহ- শাহজাদা এক পাত্র হস্তে নিয়া
ঢালিতেছে বারি গুরুর চরণে
পুলকিত হৃদে আনত-নয়নে,
শিক্ষক শুধু নিজ হাত দিয়া নিজেরি পায়ের ধুলি
ধুয়ে মুছে সব করিছেন সাফ্ সঞ্চারি অঙ্গুলি।
শিক্ষক মৌলভী
ভাবিলেন আজি নিস্তার নাহি, যায় বুঝি তার সবি।
দিল্লীপতির পুত্রের করে
লইয়াছে পানি চরণের পরে,
স্পর্ধার কাজ হেন অপরাধ কে করেছে কোন্ কালে!
ভাবিতে ভাবিতে চিন্তার রেখা দেখা দিল তার ভালে।
হঠাৎ কি ভাবি উঠি
কহিলেন, আমি ভয় করি না’ক, যায় যাবে শির টুটি,
শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার
দিল্লীর পতি সে তো কোন্ ছার,
ভয় করি না’ক, ধারি না’ক ধার, মনে আছে মোর বল,
বাদশাহ্ শুধালে শাস্ত্রের কথা শুনাব অনর্গল।
যায় যাবে প্রাণ তাহে,
প্রাণের চেয়েও মান বড়, আমি বোঝাব শাহানশাহে।
তার পরদিন প্রাতে
বাদশাহর দূত শিক্ষকে ডেকে নিয়ে গেল কেল্লাতে।
খাস কামরাতে যবে
শিক্ষকে ডাকি বাদশা কহেন, ”শুনুন জনাব তবে,
পুত্র আমার আপনার কাছে সৌজন্য কি কিছু শিখিয়াছে?
বরং শিখেছে বেয়াদবি আর গুরুজনে অবহেলা,
নহিলে সেদিন দেখিলাম যাহা স্বয়ং সকাল বেলা”
শিক্ষক কন-”জাহপানা, আমি বুঝিতে পারিনি হায়,
কি কথা বলিতে আজিকে আমায় ডেকেছেন নিরালায়?”
বাদশাহ্ কহেন, ”সেদিন প্রভাতে দেখিলাম আমি দাঁড়ায়ে তফাতে
নিজ হাতে যবে চরণ আপনি করেন প্রক্ষালন,
পুত্র আমার জল ঢালি শুধু ভিজাইছে ও চরণ।
নিজ হাতখানি আপনার পায়ে বুলাইয়া সযতনে
ধুয়ে দিল না’ক কেন সে চরণ, স্মরি ব্যথা পাই মনে।”
উচ্ছ্বাস ভরে শিক্ষকে আজি দাঁড়ায়ে সগৌরবে
কুর্ণিশ করি বাদশাহে তবে কহেন উচ্চরবে-
”আজ হতে চির-উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির,
সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ্ আলমগীর।”
এসন আসি প্রকৃত ঘটনায়। শিক্ষার্থীরা শান্ত হয়ে বসে আছে ক্লাসে। অন্যদিকে শিক্ষক চেয়ারে ঘুমাচ্ছেন। তবে এক শিক্ষার্থী তাকে হাত পাখা দিয়ে বাতাস করছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দুস্তান টাইমস এ ধরনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেছে। ঘটনাটি ভারতের বিহার রাজ্যের কোনো একটি স্কুলে ঘটেছে। ঘটনাটি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া চলছে।
ঘটনাটি প্রকাশের পর মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহারকারীরা। একজন ব্যবহারকারী বলেছেন, ওই শিক্ষক যদি ঘটনাটি ইচ্ছাকৃতভাবে করে তাহলে তাকে বহিষ্কার করা উচিত। অন্য এক ব্যবহারকারী বলেছেন, তাকে কয়েক মিনিটের মধ্যে অব্যাহতি দেওয়া উচিত।
আরো পড়ুন : এ বছরও হচ্ছে না প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা
একজন সহানুভূতি প্রকাশ করে লিখেছেন, যদি তার স্বাস্থ্য সমস্যা থাকে, তাহলে তাকে ক্ষমা করুন। অন্য একজন ব্যবহারকারী লিখেছেন, এতে শিক্ষকের কোনো দোষ নেই। কারণ একদিকে বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই। অন্যদিকে অবকাঠামোর অবস্থাও খুব খারাপ।
কিন্তু আমার কথা ভিন্ন। ২০ বছর বছর আগে এ ধরনের কাজকে প্রশংসা করা হতো। তাছাড়া এ কাজকে শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা ও সেবা হিসেবে মনে করা হতো। কিন্তু এখন সময়ের অনেক পরিবর্তন হয়েছে ।
আমাদের সমাজ ক্ষয়ে গেছে। শিক্ষকদের মূল্যায়ন কমে গেছে। সেটা আর্থিক হোক আর সামাজিক হোক।
এ কারণেই এ অবস্থা।
শিক্ষকের প্রতি ক্ষোভ বা ভালবাসা না দেখানোর প্রয়োজন নেই। ওই শিক্ষার্থীকে প্রশংসা করা উচিত। রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কার দেয়া উচিত। যে শিক্ষকের প্রতি প্রকৃত সম্মান দেখিয়েছে। গুরুর মর্যাদা দিয়েছে। তাহলেই দেখা যাবে অন্য শিক্ষার্থীদের ও শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা সম্মান বাড়বে।