স্কুল কলেজ পরিচালনায় ম্যানেজিং কমিটি-গভর্নিং বডির মাতব্বরি
বেসরকারি স্কুল কলেজে অনিয়ম দুর্নীতি চলছেই। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা টিউশনি ফি’ থেকে শুরু করে সরকারি অনুদানের টাকাও নানা কৌশলে ভাগবাটোয়ারা চলছে। অনিয়ম-দুর্নীতি হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের সব ধরণের কোনাকাটায়ও। আর এসব হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের পরিচালনার পর্ষদের অসততার কারণেই। প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের নয়, ব্যক্তিগত সুবিধা আদায়ের জন্যই এই পর্ষদের যুক্ত হতে চায় বেশিরভাগ মানুষ। ফলে এই ধরণের কমিটি আর প্রয়োজন আছে কি বা না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা, আর্থিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা তদারকি, লেখাপড়ার মান নিশ্চিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের ধারণা থেকে ‘স্কুলের ক্ষেত্রে’ ম্যানেজিং কমিটি ও ‘কলেজের ক্ষেত্রে’ গভর্নিং বডি পদ্ধতি চালু হয়। বর্তমানে এই কমিটির কার্যক্রমের কারণে শিক্ষার মান বাড়ার পরিবর্তে প্রতিষ্ঠানগুলোতে আর্থিক ও প্রশাসনিক অনিয়মের বোঝা হয়ে দাড়িয়েছে এই কমিটি। তবে ব্যতিক্রমও যে নেই, তা নয়। তবে এ সংখ্যা খুবই সামান্য।
অতিসম্প্রতি নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের অধ্যক্ষসহ তিনজনকে বরখাস্ত করে গভর্নিং বডি। যেসব অনিয়মের অভিযোগ অধ্যক্ষকে বরখাস্ত করা হয় এইসব কাজ তিনি গভর্নিং বডির নির্দেশেই করেছেন বলে গণমাধ্যমে জানিয়েছেন। এর আগে মিরপুর কলেজের অধ্যক্ষ গোলাম ওয়াদুদের বিরুদ্ধে কোটি টাকার অনিয়মের প্রমান পায় শিক্ষা বিভাগের এক তদন্তে। এই অধ্যক্ষ দাবি করেছেন সাবেক প্রায়ত সভাপতির নির্দেশেই তিনি এসব অর্থ বিভিন্ন খাতে ব্যয় করেছেন। গভর্নিং বডির সিদ্ধান্ত না মেনে চলার কোন সুযোগ নেই।
ভিকারুন নিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ হাসিনা বেগমকে অতিরিক্তি শিক্ষার্থী ভর্তির দায়ে অভিযুক্ত করে শিক্ষা অধিদপ্তরের তদন্ত কমিটি। হাসিনা বেগমও প্রমান করে দেখিয়েছেন এসব তিনি গভর্নিং বডির নির্দেশেই করেছেন। যদিও গভর্নিং বডির বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, হয়েছে এই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধেই।
রাজধানীর হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক তদন্তে দেখা গেছে, কলেজের গভর্নিং বডি ও বিভিন্ন নামে গঠিত কমিটি তিন অর্থবছরে সম্মানীর নামে ২০ লাখ ১৫ হাজার টাকা নিয়েছে। এক দিন মিটিং করলেই ব্যয় ১ লাখ টাকা। গভর্নিং বডির সভাপতি এবং বিভিন্ন কমিটির সদস্যরা কলেজের মিটিং ছাড়াও রুটিন বহির্ভূত কাজে আসতেন। এজন্য সভাপতি প্রতিদিন ৩ হাজার টাকা করে নিতেন। আর অন্য সদস্যরা নিতেন ২ হাজার করে।
রাজধানীর শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজ গভর্নিং বডির সাবেক এক সভাপতি মাসে গড়ে ৬৫ হাজার টাকা করে সম্মানী নিতেন। এছাড়া ভবন সংস্কার, আসবাবপত্র তৈরির নামেও গভর্নিং বডি ও ম্যানেজিং কমিটি লুটপাট করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শণ ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে অনিয়ম হয় তার বেশিরভাগই হয় পরিচালনা পর্ষদের কারণে।
শিক্ষকরা বলছেন, কিছু ব্যক্তি ব্যক্তিগত সুবিধা লাভের জন্য নানা কৌশলে প্রতিষ্ঠানের পরিচালনার পর্ষদের সভাপতি/সদস্য হন। অথচ প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠার সাথে, প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের জন্য তার কোন ভুমিকা নেই। পরিচালনা পর্ষদে এসেই প্রতিষ্ঠানকে নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করেন। এ কারনে প্রতিনিয়ত এসে তাদের ব্যক্তিগত আবদার মেটানোর জন্য শিক্ষকদের সাথে কর্মচারির মতো আচরণ করেন। নানা ধরণের ভয়ভীতি দেখান।
ধানমন্ডির একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এক শিক্ষক জানিয়েছেন, গভর্নিং বডির দুজন সদস্য এসে সবসময় বসে থাকেন। কিভাবে কোন খাত দেখিয়ে টাকা-পয়সা নেয়া যায় সেটাই তাদের প্রধান চিন্তা। শিক্ষকদের সাথে অসাচরণ করে। ধমক দেয়। কোন কিছুর প্রতিবাদ করতে চাইলেই চাকরি খাওয়ার হুমকি দেয়া হয়। আর শিক্ষকরা ভয়ে এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন না।
রাজধানীর একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক জানিয়েছেন, প্রতিষ্ঠানের জন্য ১ টি খাতা কিনলেও পরিচালনা পর্ষদের এক প্রভাবশালী সদস্যের পরিচিত দোকান থেকে কিনতে হয়। অথচ অন্য দোকান থেকে কিনলে কম মূল্যে পাওয়া যেতো। এভাবে প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি মালামাল কেনাকাটার ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। তাদের এই কর্মকান্ডের জন্য আমরা অসহায়।
অন্য প্রতিষ্ঠানের এক শিক্ষক জানান, স্কুলের ড্রেস কোন টেইলার্স থেকে বানানো হবে তা নির্ধারণ করে দেন তারা। মূল্য যাচাই করা হয় না। ড্রেস বানানো থেকেও কমিশন নিয়ে থাকে পর্ষদের সদস্যরা। এছাড়া সব ধরণের কেনাকাটা থেকেই কমিশন নিয়ে থাকে।
যে প্রতিষ্ঠানের আয় যত বেশি, যে প্রতিষ্ঠানের একাউন্টে টাকা যত বেশি ; সেখানের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা সক্রিয় বেশি। এ কারন অর্থ লুটপাটের সুযোগ থাকে। প্রতিষ্ঠানের আয় বেশি এমন এক প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন শিক্ষক বলেন, প্রতিষ্ঠানের ভবন কয়েকমাস আগে রং করানো হয়েছে। কিন্তু আবারো সেখানে রং করানো হয়। ভালো ভালো কক্ষ ভেঙে সংস্কারের নামে টাকা তুলে নেয়া হয়। আর এসব কাজ পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা নিজের পরিচিত প্রতিষ্ঠান থেকে বা নিজেই করেন। আর এ খাতে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি করেন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক ও আর্থিক অনিয়ম তদন্তের দায়িত্ব পালনকারী সংস্থা পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিষ্ঠানের ৯৫ ভাগ অনিয়মই ম্যানেজিং কমিটির কারণে হয়ে থাকে। বোর্ড টাকা নিয়ে অযোগ্যদের যোগ্য বানিয়ে শিক্ষক-কর্মচারী হিসাবে নিয়োগ দেয়। বিভিন্ন কৌশলে প্রতিষ্ঠানের টাকা আত্মসাৎ করে। প্রতিষ্ঠানের যুগ্ম-পরিচালক বিপুল চন্দ্র সরকার বলেন, পদাধিকার বলে গভর্নিং বডি/ম্যানেজিং কমিটির সদস্য সচিব থাকেন অধ্যক্ষ/প্রধান শিক্ষক। এ কারণে কোনো অনিয়মের দায়ভারের জন্য অধ্যক্ষ/প্রধান শিক্ষককে দায়ী করা হয়।
আজিজুল ইসলাম নামে এক অভিভভাবক বলেন, পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা শিক্ষার্থীদেও সুযোগ সুবিধা দেখে না। তাদের সাথে শিক্ষার্থীদের সমস্যা নিয়ে কথা বললে তা শুনে না। অভিভাবকদেও সাথে কথাও বলতে চায় না। মনে হয় তারা প্রতিষ্ঠানের মালিক আর আমরা ভিখারী। এ অবস্থা থেকে পরিত্রান চাই।
মিরপুরের একটি নামি প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন অভিভাবক জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠানটিতে অনেক সমস্যা রয়েছে। অযাচিত ফি শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয় প্রতিনিয়ত। কোন খাতে কোন ফি নেয়া হয় তাও জানানো হয় না। এ বিষয়ে শিক্ষকদের সাথে জানতে চাওয়া হলে তারা জানায় পরিচালনা পর্ষদ করেছে। আর এ বিষয়ে কথা বলতে পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের কোথাও দেখা মিলে না। কালো গ্লাসের গাড়িতে করে চলাফেরা করে। কোন সমস্যার কথা শুনতেও চায় না। সমাধানও করতে চায় না।
সালমা জাহান নামে এক অভিভাবক বলেন, পরিচালনা কমিটির কর্মকান্ডে আমরা বিরক্ত। অসহায়।
বিধিমালায় ম্যানেজিং কমিটি ও গভর্নিং বডির ১৬টি দায়িত্ব পালনে বাধ্যবাধকতা থাকলেও গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর মধ্যে বই, ল্যাবরেটরি, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য শিক্ষা উপকরণের ব্যবস্থা করে দেয় সরকার। নিয়োগ ও ভর্তি বাণিজ্য এবং প্রতিষ্ঠানের ফান্ড থেকে বেনামে টাকা খরচ করা ছাড়া খুব একটা দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায় না। অন্য দায়িত্বগুলোর প্রতি তাদের আগ্রহ নেই।
স্বাধীনতার পর থেকে ব্যক্তি উদ্যোগেই চলত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ১৯৮০ সাল থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়। তখন থেকে মূল বেতনের ৫০ শতাংশ দিতো সরকার। এরপর থেকে তা বাড়তে থাকে। ২০০৪ সাল থেকে শতভাগ বেতনই দিচ্ছে সরকার। এ কারণে এই ধরণের পর্ষদের আর প্রয়োজন আছে কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অভিভাবক ও শিক্ষকরা।
নিজামুল হক